সাইফুর রহমান, স্টাফ রিপোর্টার:
মঙ্গলবার সকাল থেকেই নতুন করে উত্তপ্ত উঠল ভারতের রাজধানী দিল্লি। দিল্লিতে সিএএ-বিরোধী ও সমর্থকদের সংঘর্ষ এখন রণক্ষেত্রে রূপ নিয়েছে। সোমবার সন্ধ্যার পর থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত ওই সংঘর্ষ দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি করেছে। সংঘর্ষে ১৩ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেলেও শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা আরো বাড়তে পারে বলে আশংকা করা হচ্ছে। পাশাপাশি গুরুতর আহত অবস্থায় দিল্লির জিটিবি হাসপাতাল’সহ বিভিন্ন হাসপাতালে দেড়শতাধিক চিকিৎসাধীন আছেন। তাদের দেখতে মঙ্গলবার দুপুরে হাসপাতালে যান দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল এবং তার ডেপুটি উপমুখ্যমন্ত্রী মণীশ সিসৌদিয়া। সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) নিয়ে গত তিন দিন ধরেই ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে।
মঙ্গলবার সকালে দিল্লির মৌজপুর এবং ব্রহ্মপুরীতে আবারো সিএএ-বিরোধী ও সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধে। পরস্পরকে লক্ষ্য করে শুরু হয় পাথরবৃষ্টি। আগুন ধরিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয় বেশ কয়েকটি মোটরসাইকেলও। দুপুরে গুলিও চলে সেখানে। সংঘর্ষের মাঝেই মৌজপুরে একটি ই-রিকশায় ভাঙচুরও চালানো হয়। রিকশার যাত্রীদের মূল্যবান জিনিসপত্রও লুট করে দুষ্কৃতীরা। খবর পেয়ে তড়িঘড়ি ঘটনাস্থলে পৌঁছায় পুলিশ ও র্যাপিড অ্যাকশন ফোর্স (র্যাফ)। তবে বেশির ভাগ সংঘর্ষস্থলে হিন্দুত্ববাদিদের পক্ষ নিয়ে দিল্লি পুলিশের বিরুদ্ধে নিষ্ক্রিয় থাকার অভিযোগ উঠেছে। দিল্লিতে নাগরিকত্ব আইনের সমর্থক হিন্দুত্ববাদি গুণ্ডারা এক মুসলমান বিক্ষোভকারীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
তবে মঙ্গলবার বেলা যত বাড়তে থাকে, নতুন করে ততই বাড়তে থাকে অশান্তি। দুপুর ২টা নাগাদ ভজনপুরার কাছে দুই গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। লাঠি হাতে একে অপরের উপর চড়াও হন দু’পক্ষের লোকজন। চাঁদবাগের কাছেও দুই গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধে। সোমবারের মতোই ফের পরস্পরকে লক্ষ্য করে তারা পাথর ছোঁড়ে বলে অভিযোগ। স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, গত তিন দিন ধরে সংঘর্ষ চললেও, এ দিনও এলাকায় তেমন পুলিশ চোখে পড়েনি। এজন্য সংঘর্ষ আরো চরম আকার ধারণ করে। মৌজপুর এবং ব্রহ্মপুরীর মতো একই পরিস্থিতি কারওয়াল নগরে। ভোররাতে সেখানে একটি টায়ার কারখানায় বিক্ষোভকারীরা আগুন ধরিয়ে দেয় বলে জানা গিয়েছে। আগুন ধরানো হয় বেশ কিছু গাড়িতেও। তবে পুলিশি নিরাপত্তা না পাওয়ায় এখনও পর্যন্ত সেখানে গিয়ে পৌঁছয়নি দমকলবাহিনী। উত্তর-পূর্ব দিল্লির দমকল বিভাগের ডিরেক্টরের তরফে জানানো হয়েছে, সোমবার থেকে এ দিন ভোর ৩টা পর্যন্ত দিল্লির নানা প্রান্ত থেকে তাদের কাছে ৪৫ বার ফোন এসেছে। বিক্ষোভকারীদের হাতে তাদের তিন কর্মী আহত হয়েছেন। একটি গাড়িও জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। তাই পরিস্থিতি বুঝে পদক্ষেপ নিচ্ছেন তারা।
এদিকে গোটা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে দিল্লি পুলিশও। তাদের তরফে একটি বিবৃতি প্রকাশ করে বলা হয়েছে,‘পরিস্থিতি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। উত্তর-পূর্ব দিল্লিতে সংঘর্ষ অব্যাহত বলে ফোনে লাগাতার অভিযোগ পাচ্ছি আমরা।’ সিএএ সমর্থক ও বিরোধীদের মধ্যে সংঘর্ষ চরম আকার ধারণ করায় সোমবারই দিল্লির একাধিক মেট্রো স্টেশন বন্ধ রাখা হয়েছিল। সেই ধারাবাহিকতায় মঙ্গলবারও জাফরাবাদ, মৌজপুর-বাবরপুর, গোকুলপুরী, জোহরি এনক্লেভ এবং শিব বিহার মেট্রো স্টেশন বন্ধ রাখা হয়। ওই সমস্ত স্টেশনে বন্ধ রাখা হয়েছে মেট্রো চলাচলও। উত্তর-পূর্ব দিল্লির সমস্ত সরকারি এবং বেসরকারি স্কুলও বন্ধ রাখা হয়েছে। একাধিক জায়গায় জারি হয়েছে ১৪৪ ধারা। সোমবারের সংঘর্ষের ঘটনায় এফআইআর দায়ের করতে চেয়ে ইতিমধ্যেই সুপ্রিম কোর্টে আবেদন জানিয়েছেন মুখ্য তথ্য কমিশনার ওয়াজাহত হাবিবুল্লা। বুধবার তার সেই আবেদনের শুনানি করবে শীর্ষ আদালত।
অন্যদিকে, গোটা ঘটনায় বিশেষ তদন্তকারী সংস্থা (সিট) আনা নিয়ে দিল্লি হাইকোর্টে আরও কয়েকটি আবেদনের শুনানি রয়েছে বুধবার। সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) তুলে নেয়া সংক্রান্ত শাহিনবাগের তরফে যে দু’টি আবেদন জমা পড়েছে, বুধবার তারও শুনানি করবে শীর্ষ আদালত। রাজধানীর আইন-শৃঙ্খলা কেন্দ্রের হাতে রয়েছে। তা নিয়ে সোমবারই লেফটেন্যান্ট গভর্নর অনিল বৈজলের সঙ্গে একদফা কথা হয় দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের। বাহিনী পাঠানো হবে বলে বৈজল তাকে আশ্বস্ত করেছেন বলে সেই সময় জানান কেজরিওয়াল। কিন্তু এ দিন নতুন করে সংঘর্ষ ছড়ানোয় ফের উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তিনি। টুইটারে কেজরিওয়াল লিখেছেন, ‘দিল্লির কিছু জায়গায় যে পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে, তা নিয়ে চিন্তিত আমি। শহরের সর্বত্র যাতে শান্তি বজায় থাকে, একজোট হয়ে আমাদেরই তা সুনিশ্চিত করতে হবে। সকলকে আমার অনুরোধ, সংঘর্ষ ত্যাগ করুন। যেখানে যেখানে বিক্ষোভ হচ্ছে, সেখানকার বিধায়কদের সঙ্গে বৈঠকে বসছি আমি। উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গেও কথা হবে।’
দিল্লির পরিস্থিতি নিয়ে সোমবার রাতেই দিল্লি পুলিশের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন ওই বৈঠকে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই মুহূর্তে ভারতের রাজধানীতে রয়েছেন। তাই যত শিগগির সম্ভব পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে বলে নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। এ দিন দুপুরেও অরবিন্দ কেজরিওয়াল, অনিল বৈজল এবং অন্য রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন অমিত শাহ।